ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সুন্দর সমন্বয়ের লীলাভূমি বিক্রমপুর তথা বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন। বিক্রমপুর তথা বজ্রযোগিনী ইউনিয়ন শুধু ইতিহাসের নয়, একটি জাতির প্রাণকেন্দ্র। বাংলাদেশের প্রাণ স্পন্দন। নবম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গে বৌদ্ধ, সেন, মুসলিম-পাঠানদের শাসনকালকে বাঙালী জাতির আত্মবিকাশের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে ধরা হয়। ভারত উপমহাদেশে জাতিগত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা দখলের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও শিক্ষা সংস্কৃতি বিকাশে তারা ছিল উদার। আর বিক্রমাদিত্যের বিক্রমপুরে বৌদ্ধ, সেন, মুসলিম, পাঠানদের রাজত্বকালে গড়ে উঠেছিল শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ ঐক্য ধারা। সেই সংস্কৃতির ঐক্যের ধারাই প্রাচীন বঙ্গের ইতিহাস।
কারা ধারণ করে রাখবে সেই বিদদ্যুাতসাহী অনুরাগীদের?
সেই মহীয়সী বিক্রমপুর কিংবদন্তীর অহংকার নিয়ে আজও কীর্তিনাশা পদ্মার বুকে ধুকে ধুকে মরছে। আজ সেই প্রদীপের আলো যদিও ম্লান, তবু স্তিমিত নয়। যখন নবদ্বীপ, গৌড়, সোনারগাঁ, ঢাকা সপ্তগ্রাম জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেনি তারও পূর্বে ৯শ’ ৮০ সালে বিক্রমপুরস্থ বজ্রযোগিনী গ্রামে বৌদ্ধ বাঙালী পন্ডিত শ্রী জ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর ও গণকপাড়া গ্রামে শীলভদ্রের জন্ম হয়। এই দুই বাঙালী মনীষী আধুনিক বিশ্বে মানবতার কিংবদন্তী।
এছাড়া ইতিহাস প্রসিদ্ধ আমাদের বিক্রমপুরের মাটিতে বিভিন্ন সময়ে বহু বিশ্ববিখ্যাত রাস্ট্রনায়ক ও উদারনৈতিক ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটেছে। এরমদ্যে ১৩৭৮ সালে দ্বিতীয় বল্লালসেনের আমলে ইসলাম ধর্ম প্রচারক বাবা আদম, ১৫০৬ সালে সুলতানী আমলে সৈয়দ হুসেন শাহের সময়ে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা কলির দেবতা শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু এবং ১৬২৪ সালের মে মাসে বিশ্ববিখ্যাত তাজমহলের প্রতিষ্ঠাতা ময়ূর সিংহাসনের অধিপতি মোগল সম্রাট শাহজাহান ঢাকা থেকে নৌপথে প্রথমে লক্ষ্যার তীরে খিজিরপুরে যাত্রাবিরতি এবং যাত্রা বিরতির পর বিক্রমপুরে পৌঁছেন। শাহজাহান বিক্রমপুরে তিনদিন অতিবাহিত করে অবশেষে কলাকোপা পৌঁছেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে বিক্রমপুরবাসী আপোষহীন। তাই মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে আড়ফুল বাড়িয়া গ্রামের দু’সহোদর বাঙালী বিপ্লবী চাঁদ রায় ও কেদার রায় বিক্রমপুরের অর্ন্তগত পদ্মা তীরবর্তী শ্রীপুর দুর্গ থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মানসিংহ ক্ষিপ্ত হয়ে তৃতীয়বার বিক্রমপুরে এসে বার ভূঁইয়াদের মতভেদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পদ্মার তটস্থিত বিক্রমপুরের রাজধানী কেদার রায়ের প্রিতম শ্রীপুর দুর্গ জয় করেন।
একদিকে যেমন অতীত বিক্রমপুরের শৌয-বীর্য আমাদের জাতীয় সত্তাকে শত শত বছর লালন করেছে তেমনি বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের অনুরক্ত বিক্রমপুরের রাজনগর গ্রামের রাজা রাজবল্লভ সিরাজদৌল্লার হত্যার চক্রান্তে জড়িত থেকে বিক্রপুরের ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করেছে। কিন্তু না হাজার বছরের চেতনা বিক্রমপুরবাসীকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে শক্তি যুগিয়েছে। সেই রক্ত পলাশের রক্তিম ছটায় উনবিংশ শতাব্দীর সর্বভাগে বিক্রমপুরে ফরায়েজী আন্দোলনের দানা বাঁধতে থাকে। ফরায়েজী আন্দোলন যখন ফরিদপুর, ২৪ পরগনায় বিস্তৃতি লাভ করে তখন মুহম্মদ মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার নেতৃত্বে বিক্রমপুরের জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে মুসলিম ও হিন্দু কৃষকরা সংগঠিত হতে থাকে। পরবর্তীতে সেই আন্দোলনের অব্যাহত ধারা বৃটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়।
দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুরে অবস্থিত ছিল। ঐ সময় বঙ্গেশ্বরগণ বিক্রমপুর থেকেই রাজ্যশাসন করতেন। বঙ্গদেশের প্রাচীন রাজধানী ছিল বর্তমানে তা রামপাল নামে পরিচিত। পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পাল থেকে শুরু করে পরবর্তী সেন রাজাদের রাজত্বকাল সাড়ে চারশ বছরের বেশি হবে। এদরে মধ্য প্রায় সব রাজাই বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। পাল বংশের রাজা ধর্মপাল ও রাজা মহিপাল এবং সেন বংশের রাজা বিজয় সেন, রাজা বলস্নাল সেন ও রাজা লÿণ সেন যদিও ধর্ম সম্প্রসারণে উৎসাহী ছিলেন তথাপি তারা পূর্ববঙ্গেরই অধিপতি ছিলেন, এমনকি কোন কোন রাজা বঙ্গপতি উপাধি ধারণ করে গৌরববোধ করতেন।
ঢাকার অন্তর্গত মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন এক বিস্তীর্ণ এলাকাকে বর্তামনে বিক্রমপুর নামে পরিচয় দিলেও বিক্রমপুরের ভৌগলিক সীমারেখা ছিল ৯০০ বর্গমাইল। কিন্তু বর্তমানে পদ্মার ভাঙ্গনে ওলটপালটে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৬২ বর্গমাইল।
ঈশ্বর বৈদিক বিক্রমপুরের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘বীরেশ্বর শংকর বসতি ব্রক্ষ্মপত্র জল কল্লোল বলায়িত, বিবিধ মনোহর মন্দির নগর তরু বিবাদি ভূষিত ও বিধি বধূগণ সেবতি, অর্থাৎ বিক্রমপুর ক্ষুদ্র একটি পরগণা হলেও বাংলার সভ্যতা ও সুউচ্চ শিল্পের আঙ্গিকে মহামূল্য হীরকতুল্য।
বিক্রমপুরের নাম উৎপত্তি সম্বন্ধে বিপ্রকুল কল্পলতিকীয় বলা হয়েছে সেন বংশীয় পূর্বপুরুষ নিভুজ সেন, বীর সেন প্রভৃতি রাজারা দক্ষিণাত্য হতে বঙ্গে আগমন করে এবং তাদের বংশধর বিক্রম সেনই বিক্রমপুর পরগনার স্থাপয়িত।